ভূমির পুনর্যৌবন লাভ (Rejuvenation of land forms) | পুনর্যৌবন লাভ এর ফলে গঠিত ভূমিরূপ গুলি কি কি? হ্ময়চক্র |

ভূমির পুনর্যৌবন লাভ
ভূমির পুনর্যৌবন লাভ


ভূমির পুনর্যৌবন লাভ (Rejuvenation of land forms)

    ভূমির পুনর্যৌবনলাভ (Rejuvenation of land forms) - ক্ষয়চক্রের বিভিন্ন বাঁধার ফলে নদীর শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং নদী তার পূর্ববর্তী মসৃণ উপত্যকায় আবার নতুন করে হ্ময়কাজ শুরু করে। একে ভূমির পুনর্যৌবন লাভ বলে।

    নদীর পুনর্যৌবনলাভ (Rejuvenation of river)- সমুদ্রপৃষ্ঠের পতন ঘটল অথবা ভূ আলোড়নে ভূমিভাগের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে নদীর ক্ষয় কাজ ক্ষমতা বেড়ে যায়। একে নদীর পুনর্যৌবন লাভ বলে।

পুনর্যৌবন লাভের উপায় বা শ্রেণীবিভাগ:

ভূমিরূপের পুনর্যৌবন লাভ তিন প্রকার। যথা-

1. গতিময় পুনর্যৌবন লাভ (Dynamic Rejuvenation)- মহীভাবক বা গিরিজনি আলোড়ন এর ফলে হেলে (tilting) অথবা বেঁকে(warping) উত্থিত হয়ে ভূমিভাগের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে, নদীর গতিপথের ঢাল বেড়ে যায়। এর ফলে নদীর গতিবেগ বেড়ে যায় এবং নতুন করে বেশি পরিমাণে নিম্নক্ষয় হতে থাকে। এইভাবে পুনরুত্থিত ভূমিভাগটির পুনর্যৌবন লাভ ঘটে। একে গতিময় পুনর্যৌবন বলে।

2. সমুদ্র তলের পরিবর্তনে পুনর্যৌবন লাভ (Eustatic Rejuvenation)- সমুদ্রপৃষ্ঠের অবনমনের ফলে যে পুনর্যৌবন লাভ ঘটে, তাকে ইউস্ট্যাটিক পুনর্যৌবন লাভ বলে। দুটি কারণে এটি হয় -

A. ভূআলোড়ন- ভূআলোড়নের জন্য সমুদ্রবক্ষ অবনমিত হলে সমুদ্রের জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ও সমুদ্রপৃষ্ঠ নীচে নেমে যায়। এর ফলে তখন সমুদ্রপৃষ্ঠের সাপেক্ষে ভূমিভাগের উচ্চতা বেড়ে যায় বলে নদীর নিম্নক্ষয় বৃদ্ধি পায় এবং ভূমিভাগটি পুনর্যৌবন লাভ করে। একে বলে ভূমিপর্যায়জনিত পুনর্যৌবন লাভ।

B. হিমবাহের প্রভাব- হিমযুগে সমুদ্রের জল বাষ্পীভূত হওয়ার পর তা ঘনীভূত হয়ে তুষার রূপে পার্বত্য অঞ্চলে সঞ্চিত হয়। ফলে সমুদ্রের জলের পরিমাণ কমে যায় এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের অবনমন ঘটে ও ভূমিভাগ পুনর্যৌবন লাভ করে। একে হৈমিক বা ইউস্ট্যাটিক পুনর্যৌবন লাভ বলে।

3. স্থিতিশীল পুনর্যৌবন লাভ (Static Rejuvenation)- সমুদ্রপৃষ্ঠের অবনমন বা ভূমিভাগের উত্থান ছাড়া অন্য কোন প্রাকৃতিক কারণে নদীর নিম্নক্ষয় বেড়ে গেলে ভূমিভাগটির যে পুনর্যৌবন ঘটে, তাকে স্থিতিশীল পুনর্যৌবন লাভ বলে। সাধারণত এটি তিনটি কারণে ঘটে।যথা-

A. নদীগ্রাস- মস্তক ক্ষয়ের মাধ্যমে কোনো শক্তিশালী নদী দুর্বল নদীকে গ্রাস করলে ওই দুর্বল নদীর জল শক্তিশালী নদীতে এসে পড়ে। তখন শক্তিশালী নদীতে জলের মাত্রা বেড়ে যায়। এর ফলে নদী আগের চেয়ে শক্তিশালী হয় ও নিম্নক্ষয়ের মাধ্যমে ভূমিভাগ পুনরায় যৌবন অবস্থা ফিরে পায়।

B. নদীর বোঝা হ্রাস - নদীর বোঝা হ্রাস পেলে নদীর গতি বেড়ে যায় ও সর্বশক্তি দিয়ে নদী নিম্নহ্ময় শুরু করে। এর ফলে ভূমি ভাগ পুনরায় যৌবন অবস্থা ফিরে পায়।

C. জলবায়ুর পরিবর্তন- জলবায়ুর পরিবর্তন হলে (শুষ্ক জলবায়ু থেকে আদ্র জলবায়ুতে পরিবর্তন অর্থাৎ বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি) নদীতে জল বৃদ্ধি পায় ও নদীর নিম্নক্ষয় পূর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পায়। ফলে ভূমিভাগের পুনর্যৌবন লাভ ঘটে।


পুনর্যৌবন লাভ এর ফলে গঠিত ভূমিরূপ গুলি কি কি?

1. নিক পয়েন্ট বা নিক বিন্দু (Knick Point)-

নদী ও ভূমিভাগের পুনর্যৌবন লাভের ফলে সৃষ্ট একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিরূপ হল নিক পয়েন্ট।   

              পুনর্যৌবন লাভ এর ফলে নদীর দৈর্ঘ্য বরাবর পুরাতন মৃদু ঢাল ও নতুন খাড়া ঢালের সংযোগস্থলে সৃষ্ট খাঁজকে নিক পয়েন্ট বলে।

বৈশিষ্ট্য:

A. ইহা পুরনো ও নতুন নদী উপত্যকার সংযোগস্থল।

B. নিক বিন্দুতে নতুন ঢাল পুরানো ঢাল অপেক্ষা উঁচু হয়।

C এক্ষেত্রে নদী এক নতুন ঢালের সৃষ্টি করে।

D. নিক পয়েন্ট নদী মস্তকমুখী ক্ষয় বেশি করায় এটি ক্রমশ পিছু হটে এবং একসময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

E. নিক পয়েন্টে জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়। যেমন-

ক. ঝাড়খণ্ডের সুবর্ণরেখার হুণ্ড্রু জলপ্রপাত।

খ. মধ্যপ্রদেশে নর্মদার উপর ধোঁয়াধারার নিকপয়েন্টের জলপ্রপাত।

2. উপত্যাকার মধ্যে উপত্যকা (Valley in valley)- 

    ভূমিরূপের পুনর্যৌবন লাভের ফলে নদীর উর্ধ্ব ও নিম্নপ্রবাহের মধ্যে ভূ-প্রকৃতিগত অসংগতি(Topographic unconformity) লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত নদী অববাহিকার উর্ধাংশে ভূমিরূপ পরিণত বা বার্ধক্য অবস্থায় থাকে। অন্যদিকে নিম্নপ্রবাহে নদী পুরোনো উপত্যকাকে গভীরীকরণের মাধ্যমে সংকীর্ণ "V" আকৃতির উপত্যকা সৃষ্টি করে। উর্ধাংশে পুরোনো প্রশস্ত উপত্যকার ঢাল মৃদু থাকে ও নিম্নাংশে নবীন উপত্যকার ঢাল খাড়া হয়। এভাবে এই দুই উপত্যকার সংযোগস্থলে ঢালের বিচ্যুতি(Break of slope) জনিত একটি স্কন্ধ ভূমি(Shoulder land) গড়ে ওঠে। নিম্ন উপত্যকার আড়াআড়ি প্রস্থচ্ছেদ নিলে দেখা যায় যে, পুরাতন উপত্যাকার মধ্যে উপত্যকা অবস্থান করছে। এরূপ উপত্যকাকে "উপত্যাকার মধ্যে উপত্যকা" বা "দ্বিচক্র উপত্যকা" (Two cycle valley) বলে।

উপত্যাকার মধ্যে উপত্যকা
উপত্যাকার মধ্যে উপত্যকা


 

3. নদীমঞ্চ (River Terrace)- 

    নদীর দু'পাশে অনেক সময় এক বা একাধিক ধাপ বা মঞ্চ দেখা যায়। পুনর্যৌবন প্রাপ্তির ফলে নদী নীচে উলম্বভাবে কেটে বসে যাওয়ার জন্য পূর্বেকার নদী উপত্যকার পরিত্যক্ত প্লাবন সমভূমি নদীর দু'পাশে কিছুটা ওপরে মঞ্চের আকারে অবস্থান করে। একে নদীমঞ্চ বলে। যদি নদীমঞ্চে যথেষ্ট পলল থাকে, তাহলে তাকে পলল নদীমঞ্চ বলে। অল্প পলল যুক্ত বা পলল শুন্য নদী মঞ্চকে প্রস্তরশয্যা নদীমঞ্চ(Bed rock terraces) বলে। পুনর্যৌবন লাভ এর ফলে গঠিত নদীমঞ্চের বৈশিষ্ট্য হলো উপত্যকার উভয়পার্শ্বে মঞ্চগুলি সমান উচ্চতায় জোড়ায় জোড়ায় অবস্থান করে। তাই এদের যুগল নদীমঞ্চ(Paired Terraces) বলে। এছাড়া অসমান উচ্চতায় যেসব নদীমঞ্চ গড়ে ওঠে, তাদের  অযুগল নদী মঞ্চ বলে।

নদীমঞ্চ
নদীমঞ্চ


4. খোদিত নদীবাঁক (Incised Meander)-

পরিণত এবং বার্ধক্য অবস্থায় নদী সাধারণত বড় বড় বাঁক নিয়ে প্রবাহিত হয়। পুনর্যৌবন প্রাপ্তি ঘটলো নদী বাঁকের মধ্যে নদী উলম্বভাবে কেটে (Vertical cutting) যেমন বসে যায়, তেমনি পার্শ্বক্ষয় (Lateral erosion) করে সরতে থাকে। একে কর্তিত বা খোদিত নদীবাঁক বলে। কর্তিত নদীবাঁক দুই প্রকারের হয়, যেমন- A. নিম্নহ্ময় প্রবল থাকলে নদী সরাসরি বাঁকের মধ্যে কেটে বসে যায় ও দুপাশে সমান খাড়া প্রাচীর দ্বারা আবদ্ধ থকে। এদের সমখাড়া পরিখাবেষ্টিত (Entrenched or Intrenched) নদীবাঁক বলে।

B. কোনো কোনো ক্ষেত্রে নদীর নিম্নহ্ময় অপেক্ষা পার্শ্বহ্ময় বেশি হলে নদী একপাশে সরতে থাকে এবং সেক্ষেত্রে নদীবাঁকের উভয় পার্শ্বের ভূমির ঢাল একই প্রকার থাকে না, একপাশ বেশি খাড়া ও অন্যপাশ অপেক্ষাকৃত মৃদু ঢালযুক্ত হয়। একে অসমখাড়া পরিখাবেষ্টিত (Ingrown) নদীবাঁক বলে।

খোদিত নদীবাঁক
খোদিত নদীবাঁক

5. উত্থিত সমুদ্র সৈকত ও সমুদ্রমঞ্চ (Raised Beaches and Marine Terraces)- 

যদি সমুদ্র বহুদিন ধরে উপকূলভাগে ক্ষয়কার্য করে, তবে ওই অঞ্চলে সাধারণত অপক্ষেপ যুক্ত অথবা অধক্ষেপহীন সৈকতের সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় উপকূলভাগ উত্থিত হলে কিংবা সমুদ্রতলের পতন হলে পূর্বেকার সৈকত বর্তমান সমুদ্রতলের ঊর্ধ্বে মঞ্চ বা বেঞ্চের আকারে দাঁড়িয়ে থাকে। এই মঞ্চের উচ্চতা 50 মিটারের  কম হলে তাকে উত্থিত সমুদ্রসৈকত( Raised Beaches) ও 50 মিটারের  বেশি হলে তাকে সমুদ্রমঞ্চ(Marine Terrace) বলে। গ্রেট ব্রিটেনের দক্ষিণ ও পশ্চিম উপকূলে উত্থিত সমুদ্রসৈকত গড়ে উঠেছে।


Post a Comment (0)
Previous Post Next Post

Random Products