জীব বৈচিত্রের বিনাশ বা অবক্ষয়ের কারণ (Causes of Destruction or loss of Biodiversity) |

 জীব বৈচিত্রের বিনাশ বা অবক্ষয়ের কারণ (Causes of Destruction or loss of Biodiversity):-

বিভিন্ন কারণে জীব বৈচিত্র্যের বিনাশ ঘটতে পারে। এই সব কারণকে দুটি মূল শ্রেণীতে ভাগ করে আলোচনা করা যায়।

 

জীব বৈচিত্রের বিনাশ বা অবক্ষয়ের কারণ
Causes of Destruction or loss of Biodiversity

 A. প্রাকৃতিক কারণ (Natural Causes)

i. জলবায়ুর পরিবর্তন- বিভিন্ন যুগে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বহু প্রজাতির বিনাশ ঘটেছে। বেশিরভাগ সময় পরিবর্তনশীল জলবায়ুর সঙ্গে প্রজাতিগুলো অভিযোজন করতে না পারায় বিলুপ্ত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাস্তুতান্ত্রিক পরিবেশের বিপুল পরিবর্তন হওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় । কার্বনিফেরাস ও প্লিস্টোসিন যুগে সমগ্র পৃথিবী বরফাবৃত থাকায় অসংখ্য প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়েছে।

ii. অগ্নুৎপাত- অগ্ন্যুৎপাতের সময় যথেষ্ট মাত্রায় লাভা প্রবাহের ফলে বহু উদ্ভিদ ও প্রাণী উত্তপ্ত লাভার মধ্যে ঢাকা পড়ে যায়। এর ফলে অসংখ্য প্রজাতি বিলুপ্ত হয়। ক্রিটেশিয়াস যুগে অগ্ন্যুৎপাতের ফলে অসংখ্য প্রজাতি বিনাশের সন্ধান পাওয়া যায়।

iii. ধুমকেতু- মহাকাশ থেকে আগত গ্রহাণু বা উল্কা ভূ-পৃষ্ঠে আছড়ে পড়লে যে বিপুল পরিমাণ ধূলিকণা সৃষ্টি হয়, তাতে বহু প্রজাতির ক্ষতি হয়। ধূলিকণার আবরণ ভূপৃষ্ঠে সূর্যালোক পৌঁছাতে বাধা দেয় বলে বিপুল সংখ্যক প্রজাতি বিনষ্ট হয় অর্থাৎ জীব বৈচিত্র্যের বিনাশ ঘটে।

iv. মহীসঞ্চরণ -মহাদেশীয় ভূখণ্ডের সঞ্চরণ ঘটায় বাসস্থানের খন্ডীকরণ ঘটে। এর ফলে প্রজাতি বিনাশের সম্ভবনা বাড়ে। পাত সঞ্চালনের ফলে বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক যুগে ভূখণ্ডের সঞ্চরণ ঘটায় বহু প্রজাতির বিনষ্টের নমুনা পাওয়া যায়।

v. বন্যা খরা ও মহামারি- বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যখন বন্যা ,খরা বা  মহামারির সৃষ্টি হয় তখনও প্রজাতি বিনষ্ট হয়। বিভিন্ন রোগের প্রাদূর্ভাব বাড়লে মহামারির সৃষ্টি হয় এবং তা বাস্তুতন্ত্রের স্বাভাবিক বিন্যাসকে ব্যাহত করায় জীববৈচিত্র্যের বিনাশ ঘটে।

➧ B. মনুষ্যসৃষ্ট কারণ (Man Made Causes)

প্রাকৃতিক কারনে সঙ্গে সঙ্গে মনুষ্যসৃষ্ট কারণ ও জীববৈচিত্র্য বিনাশে সাহায্য করে। প্রকৃতপক্ষে মনুষ্যসৃষ্ট কারণ এর জন্যই জীববৈচিত্র্য বর্তমানে এক মহা সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। উল্লেখযোগ্য এসব কারণ গুলি হল –

i. বৃক্ষছেদন- ব্যাপকমাত্রায় বৃক্ষ ছেদনের জন্য উদ্ভিদ ও জীবজন্তুর আবাসস্থলের এলাকা হ্রাস পায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ বৃক্ষ বিশেষ জীবের আশ্রয়স্থল। সেই সব গাছ কাটার জন্য বিশেষ বিশেষ প্রজাতি বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে। মূলত উদ্ভিদের ওপর নির্ভর করেই অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল, পূর্বঘাট ও পশ্চিমঘাট পার্বত্য অঞ্চলে ব্যাপক ভাবে বনভূমি ধ্বংস হওয়ায় অসংখ্য স্থানীয় বা আঞ্চলিক প্রজাতি নষ্ট হয়েছে।

ii. চোরাশিকার- চোরাশিকারের জন্য প্রতিবছর বহু প্রাণীর মৃত্যু হয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে এই সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। হাতির দাঁত ,গন্ডার এবং হরিণের শিং ও চামড়া ইত্যাদি সংগ্রহের জন্য চোরাশিকার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। চোরাশিকারের  কারণে ভারতে বাঘের সংখ্যা দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে রাজস্থানের সরিস্কা অভয়ারণ্যের কথা উল্লেখ করা যায়। যেখানে চোরাশিকারের দাপটে বাঘ পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে মনে করা হয়।

iii. অতি শিকার- যথেচ্ছ মাত্রায় শিকারের মাধ্যমেও জীব বৈচিত্র্যের অবক্ষয় ঘটছে। অরণ্যের দুর্গম অঞ্চলেও শিকার করে অরণ্যকে পশুশূণ্য করে ফেলা হয়েছে। উদাহরন হিসাবে ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্যের কথা বলা যায়। যেখানে রাস্তা তৈরি করে অরণ্যের গভীরে প্রবেশ করে অতিরিক্ত শিকারকার্য চালিয়ে বহু প্রাণী প্রজাতিকে লুপ্ত করা হচ্ছে।

iv. অতিমাত্রায় পশুপালন- কৃষিকাজের ব্যাপক বিস্তার ঘটায় পশুপালনক্ষেত্র বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। তাই পশুপালকেরা  প্রায়শই অরণ্য অঞ্চলের প্রবেশ করে। অত্যধিক পশুচারণ এর জন্য ছোট গাছ, চারা গাছ, গুল্ম  ইত্যাদি নষ্ট হওয়ায় জীব বৈচিত্র্যের রূপ অবক্ষয় ঘটেছে।

v. আগন্তুক প্রাণীর আক্রমণ- বাইরে থেকে কোন প্রাণীর আগমন এবং আক্রমণ ঘটলে  স্থানীয় জীবসংখ্যার ওপর তার প্রভাব পড়ে। বহিরাগত প্রজাতির অনুপ্রবেশের ফলে স্থানীয় প্রজাতির বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে এবং ফলস্বরূপ জীব বৈচিত্র্যের বিনাশ ঘটে। যেমন জলাশয়ে কুমিরের প্রবেশ, পাখির আশ্রয়ে সাপের প্রবেশ বা উপদ্রব হলে ওই বাসস্থানের নিজস্ব প্রজাতির প্রাণীকূল ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আফ্রিকার বৃহৎ হ্রদ সমূহের (ভিক্টোরিয়া, মালাউই ও টাঙ্গানিকা) স্থানীয় মৎস্য প্রজাতির মধ্যে নীল পার্চ প্রজাতির মৎস্য সংস্থাপন করায় স্থানীয় মৎস্য প্রজাতি বিনষ্ট হয়েছে।

vi. কৃষি ও বাসভূমি সম্প্রসারণ- অরণ্য ধ্বংস করে কৃষিজমির সম্প্রসারণের  ফলে জীব বৈচিত্র্য নষ্ট হয়। শুধু তাই নয় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় বাসভূমি নির্মাণের মাধ্যমেও অরণ্য নিধন হয় এবং যার প্রভাব পড়ে জীব বৈচিত্র্যের উপর। উদাহরণ হিসেবে সুন্দরবন এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কথা উল্লেখ করা যায়। এই দুই জায়গায় ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে বসতি নির্মাণ বা পুনর্বাসন প্রকল্পের মাধ্যমে নির্বিচারে অরণ্যের সংকোচন ঘটায় জীববৈচিত্র্যের ভবিষ্যৎ এক বিশাল প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন হয়েছে।

vii.  বাস্তুক্ষেত্র বা বাসস্থান হানি- কোন জীবের স্থানীয় পরিবেশকে ওই জীবের বাস্তুক্ষেত্র বলা হয়। অনেক সময় এই বাস্তুক্ষেত্রকে (Habitat) কোন জীবের পরিবেশগত ঠিকানাও বলা হয়। এই পরিবেশ বলতে স্থানীয় জলবায়ু, মৃত্তিকা, ভূপ্রকৃতি, জল, প্রাপ্ত পুষ্টি ইত্যাদিকে বোঝায়। বিভিন্ন কারণে পরিবেশের পরিবর্তন ঘটলে স্বাভাবিকভাবেই জীবের বাস্তুক্ষেত্র সংকোচন ঘটে । ফলস্বরুপ জীববৈচিত্র্য বিনাশের সম্ভাবনাও প্রবলভাবে তৈরি হয়। 

viii. বাস্তুক্ষেত্রের অবনমন- পরিবেশের গুণগত মানের অবক্ষয় ঘটলে বাস্তুক্ষেত্রের অবনমন ঘটে। প্রত্যেক জীবপ্রজাতির সঠিক এবং উপযুক্ত বাস্তুক্ষেত্র অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তুক্ষেত্রের যদি গুণগতমান হ্রাস পায়, তখনই জীব বৈচিত্র্য বিনাশের পথ পরিষ্কার হয়। মাদাগাস্কার দ্বীপের ডোডো পাখি আজ অবলুপ্ত, কারণ সেখানে হঠাৎ শূকরছানাকে এই পাখির ডিম খাওয়ানো শুরু করায় এই বিপত্তি।

ix. বাস্তুক্ষেত্রের খন্ডীকরণ- বাস্তুক্ষেত্রের খন্ডীকরণ বা বিচ্ছিন্নকরণ বর্তমানে জীববৈচিত্র্য টিকে থাকার অন্যতম বাধা। বাস্তুক্ষেত্রের আয়তন খন্ডীকরণ এর মাধ্যমে হ্রাস পেলে বসবাসকারী জীবের খাদ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে অন্যান্য জৈবিক চাহিদা গুলির পূরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাই এক্ষেত্রে বিপুল সমৃদ্ধিশালী জীববৈচিত্র্য ও চরম সংকটের দিকে এগিয়ে যায়। কৃত্রিম উপগ্রহ মারফত প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় ক্রান্তীয় অরন্যের বর্তমান বিস্তৃতি মাত্র 75 থেকে 80 লক্ষ্ বর্গ কিলোমিটার, যা পূর্বে ছিল প্রায় 1.5 কোটি বর্গ কিলোমিটার। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক বনভূমির বিনাশ ঘটেছে। এর ফলে এই অঞ্চলে জীববৈচিত্র্যের মাত্রাও ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে।

x. ছদ্ম প্রভাব-  যখন দুই বা ততোধিক প্রজাতি একে অপরের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয় তখন বাস্তুতন্ত্রের একটি কেন্দ্রীয় প্রজাতি গড়ে ওঠে ।এই কেন্দ্রীয় প্রজাতি কোন কারণে আক্রান্ত হলে তখন তার ওপর নির্ভরশীল অন্যান্য প্রজাতি গুলির বিনাশের সম্ভবনা বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে একটি প্রজাতির বিনাশের ফলে অন্যান্য প্রজাতির বিলুপ্তির সম্ভাবনা বেড়ে যায় বলে একে ছদ্ম প্রভাব বলা হয়। উদাহরন হিসাবে ওয়াশিংটন উপকূলবর্তী অঞ্চলের তারামাছের কথা উল্লেখ করা যায়। এখানে তারামাছ কেন্দ্রীয় প্রজাতি। তাই তারা মাছের অবলুপ্তি ঘটলে তার ওপর নির্ভরশীল বিভিন্ন প্রজাতির শুক্তির (Mussles) বিলুপ্তি ঘটবে।

    xi. পরিবেশ দূষণ- পরিবেশ দূষণের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বায়ুমন্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাস বৃদ্ধির ফলে ভূমণ্ডলীয় উষ্ণতা ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে বাস্তুতন্ত্রে অত্যধিক পীড়নের সৃষ্টি হয়। রাসায়নিক দূষণের ফলে সংবেদনশীল প্রজাতি গুলি ক্রমশ অবলুপ্তির পথে ঢলে পড়ায় জীব বৈচিত্র্যের বিনাশ ঘটছে। উদাহরণ- দামোদর নদ বর্তমানে একটি জৈবিক মরুভূমিতে (Biological desert) পরিণত হয়েছে । শিল্পজাত দূষক পদার্থ নদীর জলে মিশ্রিত হওয়ায় নদীর বহু জীব অবলুপ্ত হয়েছে।

হ্রদবহুল নরওয়ে ও সুইডেনে অত্যধিক দূষণের ফলে হ্রদের মধ্যেকার বহু প্রজাতি আজ অদৃশ্য হয়েছে । সেই কারণে এই ধরনের হ্রদগুলিকে মৃত হ্রদ বলে (Dead lake। আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোতে অম্লবৃষ্টিকে হ্রদ ঘাতক (Lake killers) বলা হয়। কারণ এই বৃষ্টির ফলে হ্রদের জীববৈচিত্র্যের বিনাশ ঘটছে।

xii. বহুমুখী নদী পরিকল্পনা রূপায়ণ- নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে বহুমুখী নদী উপত্যকা পরিকল্পনার সার্থক রূপায়ণের জন্য বহু ক্ষেত্রে স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রের বিনাশ এবং বাস্তুক্ষেত্রের আয়তন হ্রাস পায়। জলাধারের অতিরিক্ত জল অনেক সময় পার্শ্ববর্তী স্থলজ বাস্তুসংস্থানকে প্লাবিত করায় জীব-বৈচিত্র্য বিনষ্ট হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায় ।

xiii. রোগ পোকার উপদ্রব- কোনো কোনো বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে ব্যাপক মাত্রায় রোগ পোকার উপদ্রব ঘটে। এই রোগ পোকার আক্রমণের ফলে বহু ক্ষেত্রে অসংখ্য প্রজাতির বিনাশ ঘটে।

যেমন- ধানের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর এক প্রকার ভাইরাসের নাম রাইস গ্রাসি শাল্ট ভাইরাস।

xiv. অতিরিক্ত অর্থনৈতিক ব্যবহার- কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ প্রকার উদ্ভিদের ব্যবহারিক গুরুত্ব মাত্রাতিরিক্ত হওয়ায় তার সংগ্রহের পরিমাণ অনেকাংশেই বৃদ্ধি পায়। তখন নির্দিষ্ট বাস্তুক্ষেত্রে অবস্থানকারী ঐ উদ্ভিদের পরিমাণ বা সংখ্যা হ্রাস পায় বলে জীব বৈচিত্র্য বিনষ্ট হয়। উদাহরণ হিসেবে বিভিন্ন প্রকার ওষুধ তৈরি হয় এমন ভেষজ উদ্ভিদ যেমন বাসক, কলসপত্রী, সর্পগন্ধা, সিঙ্কোনা ইত্যাদির নাম করা যায়। সুন্দরবন অঞ্চলে সুন্দরী গাছের সংখ্যা ও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।

xv. জনসচেতনতার অভাব- উপযুক্ত জনসচেতনতার অভাবের জন্য বিশেষ করে পরিবেশ সচেতনতার অভাবে জীব-বৈচিত্র্য আজ কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন। বর্তমানে বাস্তুতন্ত্রের ওপর মানুষের অবাঞ্চিত হস্তক্ষেপ প্রায়ই চোখে পড়ে। দক্ষিণ ভারতে চন্দন দস্যুর কার্যকলাপে চন্দন বৃক্ষ আজ অবক্ষয়ের মুখে। এভাবে বিভিন্ন সময়ে মানুষের কার্যকলাপে জীববৈচিত্র্য এক সংকটজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে।


Post a Comment (0)
Previous Post Next Post

Random Products