প্রাকৃতিক ভূগোলের নীতিসমূহ
ইমানুয়েল কান্টের নীহারিকা বা গ্যাসীয় মতবাদ আলোচনা করো (Nebular theory of E. Kant)।
✴ ভিত্তি ও জনক: 1734 খ্রিস্টাব্দে এমানুয়েল সুইডেন বার্গের
প্রাচীন নীহারিকার ধারণার ওপর ভিত্তি করে (1755খ্রি) জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট
তাঁর নীহারিকা বা গ্যাসীয় মতবাদ ব্যক্ত করেন। তত্ত্বটি নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বকে ভিত্তি
করে স্থাপিত।
✸ তত্ত্বের মূল কথা:
১. বহু কোটি বছর আগে সৌরজগৎ ছিল অতি প্রাকৃতিক (super naturally) উপায়ে
সৃষ্ট শীতল, গতিহীন, কঠিন পদার্থের বিশাল সমাহার বা মেঘপুঞ্জ।
২. এই মেঘপুঞ্জের ব্যাপ্তি ছিল তার কেন্দ্র থেকে সূর্যের নিকটতম গ্রহ পর্যন্ত।
৩. মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ফলে এই কঠিন পদার্থ গুলি পৃথক পৃথক আকর্ষণ শক্তিতে,
একে অন্যের উপর আছড়ে পড়ত ও ক্রমাগত সংঘর্ষে লিপ্ত হত।
৪. সংঘর্ষ জনিত প্রবল তাপ ও আবর্তন গতির সৃষ্টি হয়। তাই-
৫. মহাশূন্যের শীতল স্থির প্রাথমিক পদার্থের আদিম পুঞ্জটি প্রচন্ড বেগমান,
উত্তপ্ত, বিশালাকার ঘূর্ণায়মান গ্যাসীয় পিণ্ডে পরিণত হয়।একে নীহারিকা বা Nebula
বলে।
৬. মাধ্যাকর্ষণ এর ফলে নীহারিকাটি যত ঘন হয়েছে, আয়তনে তত ছোট হয়ে, বেড়েছে
তার ঘূর্ণন বেগ।
৭. প্রবল ঘূর্ণনের ফলে নীহারিকার নিরক্ষীয় তলের কেন্দ্রাতিগ বল অভিকর্ষ
বল অপেক্ষা বহুগুণ বেড়ে যায়। তাই-
৮. কেন্দ্রাতিগ বলের প্রভাবেই নীহারিকার প্রান্তদেশ থেকে একে একে নয়টি
বলয় ছিটকে যায়, বহুস্তর আংটির মত।
৯. নয়টি আংটির ন্যায় বিচ্ছিন্ন অংশ ঘনীভূত হয়ে 9 টি গ্রহ সৃষ্টি হয়।
১০. অনুরূপে গ্রহগুলি থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা বলয় গুলি উপগ্রহ সৃষ্টি করেছে।
১১. নীহারিকার কেন্দ্রীয় অংশটি সূর্য বা নক্ষত্রের সৃষ্টি করে।
১২. গ্রহগুলি সূর্যকে এবং উপগ্রহগুলি নিজের চারদিকে ঘুরতে থাকে।
অর্থাৎ-
১. স্থির, কঠিন, শীতল পদার্থ রূপে সৌরজগৎ।
২. কঠিন পদার্থের ক্রমাগত সংঘর্ষ।
৩. প্রচন্ড উত্তাপ ও আবর্তন গতি।
৪. বেগমান উত্তপ্ত গ্যাসীয় নীহারিকা।
৫. নীহারিকার নিরক্ষীয় তলে কেন্দ্রবিমুখ বল সৃষ্টি।
৬. বলয়ের আকারে বিচ্ছিন্ন 9 টি গ্রহ সৃষ্টি
✹ সমালোচনা:
১. এই মতবাদটির কোনো বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি নেই।
২. কান্ট গ্যাসীয় পুঞ্জ সৃষ্টির আদি উৎসের কথা বলেননি।
৩. কান্ট সূর্যের যে ঘূর্ণনের গতিবেগ কল্পনা করেছেন তা সূর্যের বহিরাংশ
থেকে নতুন বলয় সৃষ্টির পক্ষে নিতান্ত কম।
৪. তিনি শীতল, গতিহীন পদার্থের যে গতি সৃষ্টির কথা বলেছেন- তা "কৌণিক
ভরবেগ সংরক্ষণ নীতি" মেনে চলে না।
৫. মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রয়োগ সংক্রান্ত ব্যাখ্যাটি বেশ দুর্বল।
৬. বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন- শীতল প্রাথমিক পদার্থের সংঘর্ষে বিপুল তাপ সৃষ্টি
হতে পারে না।
৭. ঘূর্ণায়মান নীহারিকাটির আয়তন বৃদ্ধি পেলে তার গতিবেগ বাড়ার কোন উল্লেখ
নেই।
৮. আদি বস্তুকণা পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হলেই পদার্থের মধ্যে আবর্তন
বেগ সৃষ্টি হতে পারে না।
৯. এই প্রক্রিয়ায় গ্রহ-উপগ্রহ সৃষ্টি হলে এদের আবর্তনের দিক (পশ্চিম-পূর্ব)
একই দিকে হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে তা নেই। বৃহস্পতি ও শনির উপগ্রহ গুলি বিপরীত দিকে
ঘুরছে।
✺ গুরুত্ব:
১. মতবাদটি খুব সহজ সরল ও বোধগম্য।
২. নয়টি গ্রহ এবং তাদের উপগ্রহ সৃষ্টির ব্যাখ্যা এই তত্ত্বে আছে।
৩. এই তত্ত্বে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির উপযোগিতা ও প্রয়োগ দেখানো হয়েছে।
৪. সৌরজগতের উৎপত্তি এবং পৃথিবীর জন্মের ব্যাখ্যা এত সহজ-সরল এর আগে কখনও
দেওয়া হয়নি।
৫. এই তত্ত্ব পরবর্তী কালের বিজ্ঞানীদের অনেক আবিষ্কারে সাহায্য করেছে।
৬. এই তত্ত্বানুসারে পরিষ্কার যে পৃথিবী উত্তপ্ত জ্বলন্ত গ্যাসীয় অগ্নিপিণ্ড
থেকে তাপ বিকিরণ করে শীতল ও কঠিন হয়েছে।
জিন্স ও জেফ্রিসের জোয়ারী মতবাদটি আলোচনা করো।
✳ জনক: চেম্বারলিন ও মুলটনের গ্রহকণা মতবাদ ও ল্যাপলাসের
নীহারিকা মতবাদের সীমাবদ্ধতা দূরীকরণ ও সমালোচক মতবাদ হলো জোয়ারী তত্ত্ব। এই তত্ত্বের
জনক-
১. ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার জেমস জিন্স ও ২. অধ্যাপক হ্যারল্ড জেফ্রিস(1918-19)।
❋ গ্রহ সৃষ্টি ও তত্ত্বের মূলকথা:
১. সূর্যের তুলনায় ভর ও আয়তনে বহুগুণ বড় একটি আগন্তুক নক্ষত্র নিজ গতিপথে
সূর্যের কাছে আসে।
২. ওই নক্ষত্রের মাধ্যাকর্ষণের টানে সূর্যের গ্যাসীয় মণ্ডলে প্রবল জোয়ার
সৃষ্টি হয়।
৩. ওই নক্ষত্রটি যতই সূর্যের কাছে আসতে থাকে ততই আকর্ষণ ও জোয়ার বৃদ্ধি
পেতে থাকে। ফলে-
৪. সূর্যের গ্যাসীয় পিণ্ডটি বড় ও লম্বাটে হয় ও দুই প্রান্ত সরু, মাঝখানটা
মোটা হয়ে লম্বাটে মাকু বা পটলের আকার নেয়।
৫. পটলাকার গ্যাসীয় পিণ্ডটির আকার বড় হতে হতে সূর্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে
ছিটকে যায়।
৬. অগ্রসরমান আগন্তক নক্ষত্রটি বিচ্ছিন্ন পিণ্ডটিকে ঘূর্ণন গতি প্রদান করে,
যার ফলে পিণ্ডটি সূর্যের চারদিকে ঘুরতে থাকে।
৭. এক সময় তাপ বিকিরণ করতে করতে পটলাকার পিণ্ডটি তরল থেকে কঠিন ও কঠিনতর
হয়।
৮. সময় পরে পটল পিণ্ডটি ভেঙে গিয়ে পৃথিবী সহ অন্যান্য নটি গ্রহ সৃষ্টি
করে।
উল্লেখ্য পটলের
মধ্যভাগ থেকে বৃহৎ গ্রহ (বৃহস্পতি) ও প্রান্ত থেকে ক্ষুদ্র গ্রহের সৃষ্টি হয়েছে।
✳ উপগ্রহ সৃষ্টি:
১. গ্রহগুলি প্রথমাবস্থায় নমনীয়, গ্যাসীয় তরল থাকাকালীন সূর্যের আকর্ষণে
গ্রহ গুলিতে জোয়ার জনিত স্ফীতির সৃষ্টি হয়।
২. গ্রহগুলি থেকে স্ফীত অংশ বিচ্ছিন্ন হয় এবং ধীরে ধীরে কঠিন থেকে উপগ্রহ
সৃষ্টি হয়।
আগন্তক নক্ষত্র - সূর্যপৃষ্ঠে জোয়ার - সূর্যের গ্যাসীয় পৃষ্ঠের পটলাকার
- বিচ্ছিন্ন পটলপিণ্ড -
পটল পিন্ডের কাঠিন্য - ভাঙ্গন - গ্রহ সৃষ্টি
❇ সমালোচনা:
১. বিজ্ঞানী বি.লেভিনের মতে অসীম মহাকাশের নক্ষত্রের মধ্যে এত বিশাল দূরত্ব
আছে যে কোনো নক্ষত্রের পক্ষে সূর্যের উপর এতটা প্রভাব বিস্তার সম্ভব নয়।
২. সূর্য হালকা হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাসের সমষ্টি এবং গ্রহ, উপগ্রহগুলি
ভারী লোহা, নিকেল ও অ্যালুমিনিয়ামে গঠিত। তাই সূর্য দেহ থেকে গ্রহ-উপগ্রহের সৃষ্টি
হয়নি।
৩. সৌরজগতের মাঝখান থেকে দুদিকে আয়তন অনুযায়ী গ্রহ-উপগ্রহের বিন্যাস ব্যাখ্যা
করা যায়নি।
৪. উৎপন্ন গ্রহ, উপগ্রহগুলির আবর্তন ও পরিক্রমণ গতি কিভাবে হল তা নিয়ে
ধোঁয়াশা রয়েছে।
৫. জেফ্রিস বিশ্বাস করতেন উৎপন্ন গ্রহগুলি দ্রুত তাপ বিকিরণ করে শীতল হয়ে
বর্তমান অবস্থায় আসে। বিজ্ঞানীদের মতে বাস্তবে এই এত দ্রুত তাপ বিকিরণ সম্ভব নয়।
৬. এই মতবাদ অনুসারে গ্রহ, উপগ্রহ, উল্কা, ধূমকেতুর মোট কৌণিক ভরবেগ সৌরজগতের
98%এবং বাকি 2% ভরবেগ আছে সূর্যের।
সূর্যের অতি সামান্য অংশ কিভাবে মূল অংশ থেকে 98% ভরবেগ সঙ্গে নিয়ে এলো
তার সঠিক ব্যাখ্যা মেলে না।
৭. জেফ্রিস 1951তে গুটেনবার্গকে লেখা চিঠিতে তার তত্ত্বের ত্রুটির কথা স্বীকার
করেন ও পরিমার্জনার কথা বলেন।
✱ মূল্যায়ন:
১. তত্ত্বটি অতি সহজ ও সাবলীল।
২. এই তত্ত্ব দ্বারা চেম্বারলিন ও মুলটনের গ্রহকণা মতবাদ এবং ল্যাপলাসের
নীহারিকা মতবাদের ত্রুটি দূর হয়।
৩. পৃথিবীর কঠিনগত বৈশিষ্ট্যের বহু ব্যাখ্যা এই তত্ত্বে পাওয়া যায়।
৪. আধুনিক বহু তত্ত্বের পথপ্রদর্শক হলো এই তত্ত্ব।
ল্যাপলাসের নীহারিকা মতবাদ ব্যাখ্যা করো।
✱ জনক: ফরাসি গণিতবিদ পিয়ের সীমন ল্যাপলাস 1796খ্রী তাঁর
নীহারিকা মতবাদটি প্রকাশ করেন। ইহা 1755 খ্রী প্রকাশিত কান্টের নীহারিকা মতবাদের পরিমার্জিত
এবং বিজ্ঞানসম্মত মতবাদ।
✱ তত্ত্বের মূলকথা:
১. সৌরজগতের আদিতে মহাশূন্যে এক বিশাল উত্তপ্ত নীহারিকা ছিল।
২. নীহারিকাটি নিজ অক্ষের চারিদিকে প্রচণ্ড বেগে ঘুরত।
৩. নীহারিকাটি ক্রমশ তাপ বিকিরণে শীতল হতে থাকে। ফলে-
৪. নীহারিকা মধ্যস্থ পদার্থের সংকোচন ঘটে এবং সংকোচন যত বাড়ে, ঘূর্ণন বেগও
তত বাড়ে।
৫. ঘূর্ণন বেগ একসময় এতই বৃদ্ধি পায় যে উহার নিরক্ষীয় মন্ডলে অপকেন্দ্র
বল ও অভিকর্ষ বল দুই-ই সমান হয়।
৬. নীহারিকার মধ্যভাগের চেয়ে কিনারার দিকে তাপ বিকিরণের হার বেশি ছিল,
তাই বাইরের দিকটি বেশি সংকুচিত হয়।
৭. নীহারিকা গঠনকারী পদার্থের অবস্থা ও ঘূর্ণন গতি ও কেন্দ্রবিমুখ বলের
ভারসাম্য নষ্ট হয়। ফলে-
৮. নীহারিকার নিরক্ষীয় তলের প্রান্তভাগ থেকে
নয়টি বলয় ছিটকে বেরিয়ে আসে। তাই-
৯. নীহারিকার কেন্দ্রীয় অংশ একটি নক্ষত্র বা সূর্যে পরিণত হয়।
১০. বিচ্ছিন্ন ঘূর্ণায়মান নয়টি বলয় থেকে 9 টি গ্রহ সৃষ্টি হয়।
১১. অনুরূপে নয়টি গ্যাসীয় বলয় থেকে আরও ক্ষুদ্র একাধিক বলয় ছিটকে মহাশূন্যে
বেরিয়ে যায় যা শীতল হয়ে উপগ্রহ সৃষ্টি করেছে।
১২. এইভাবে আমাদের সৌরজগৎ অর্থাৎ সূর্য, পৃথিবী, গ্রহ ও অন্যান্য উপগ্রহের
সৃষ্টি হয়েছে।
✱ সমালোচনা:
১. ল্যাপলাস আদি নীহারিকার কথা উল্লেখ করলেও সেটি কোথা থেকে তাপ সংগ্রহ
করল, ঘূর্ণন বেগ পেল তা উল্লেখ করেননি।
২. ঘূর্ণায়মান নীহারিকা থেকে কেবলমাত্র নয়টি বলয় ছিটকে গেল কেন (তার
কম বা বেশি যেতে পারত) তার ব্যাখ্যা এই তত্ত্বে নেই।
৩. এই তত্ত্বানুযায়ী সৌরজগতের বর্তমান কৌণিক ভরবেগ ব্যাখ্যা করা যায় না।
৪. বিভিন্ন উপগ্রহগুলি যে মূল গ্রহের আবর্তনের বিপরীতে আবর্তন করে এবং মূল
গ্রহের আবর্তনকাল অপেক্ষা উপগ্রহদের অনেক কম সময় লাগে এ সম্পর্কে ল্যাপলাস ধারণা দেননি।
৫. যদি মূল নীহারিকার নিরক্ষীয় তল থেকে নটি বলয় বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্ন
হয় এবং নীহারিকাটির কেন্দ্রীয় অংশ সূর্যে পরিণত হয় তা হলে সূর্যের মধ্যভাগ স্ফীত
হওয়ার কথা, কিন্তু হয়নি।
৬. গ্রহ থেকে যদি উপগ্রহের সৃষ্টি হতো তাহলে গ্রহের আবর্তনের দিকে উপগ্রহগুলি ঘুরত। কিন্তু বৃহস্পতি ও
শনির ক্ষেত্রে এই নিয়ম ঘটে না।
৭. ইংরেজ পদার্থবিদ ম্যাক্সওয়েল ও জিন্সের মতে নীহারিকা থেকে বিচ্ছিন্ন
হওয়া বলয় গুলির ভর এত বেশি ছিল না যে সেগুলি জমাট বাঁধার জন্য উপযুক্ত অভিকর্ষজ আকর্ষণ
সৃষ্টি করতে পারে।
৮. বস্তুর ভর বেশি হলেই কৌণিক ভরবেগ বেশি হবে, কিন্তু ল্যাপলাস এই ধারণা
দেননি।
৯. সংকোচনের ফলে বিক্ষিপ্ত বস্তু বলয়াকার নাও হতে পারে এবং এই পৃথকীকরণ
অবিরাম গতিতে চলতে থাকে।
১০. ল্যাপলাসের মতে অন্য গ্রহের তুলনায় সূর্যের কৌণিক ভরবেগ বেশি, কিন্তু
বাস্তবে তা নয়। গ্রহ গুলির মোট কৌণিক ভরবেগ 98%,যেখানে সূর্যের মাত্র 2%
✱ গুরুত্ব:
১. এটি কান্টের নীহারিকা মতবাদের তুলনায় বেশি বিজ্ঞানসম্মত।
২. ল্যাপলাসের তত্ত্ব থেকে গ্রহগুলির আবর্তন ও পরিক্রমণ গতির তত্ত্ব পাওয়া
যায়।
৩. বিভিন্ন গ্রহ যে একই তলে অবস্থান করছে- তার ব্যাখ্যা ল্যাপলাসের তত্ত্বে
পাওয়া যায়।
৪. তাঁর তত্ত্বে জানা যায় কীভাবে গ্রহগুলি প্রথমে গ্যাসীয়, পরে তরল ও
শেষে শীতল ও ঘনীভূত হয়ে কঠিন ভূত্বক সৃষ্টি করে।
৫. তাঁর তত্ত্ব থেকে পৃথিবী ও সৌরজগতের উৎপত্তির সহজ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
চেম্বারলিন ও মুলটনের গ্রহ কণিকা তত্ত্ব বা গ্রহাণুতত্ত্ব বা আপাত সংঘর্ষ মতবাদটি ব্যাখ্যা করো।
✩ জনক: পৃথিবীর উৎপত্তি সংক্রান্ত গ্রহাণুতত্ত্ব উপস্থাপন
করেন 1904 খ্রী বিজ্ঞানী টি.সি চেম্বারলিন ও এফ. আর মুলটন।
✩ তত্ত্বের মূল কথা:
১. বুফনের ধুমকেতু মতবাদকে ভিত্তি করে
চেম্বারলিন ও মুলটন তাঁর গ্রহকণিকা মতবাদটি উল্লেখ করেন।
২. পৃথিবী বা গ্রহ-উপগ্রহ সৃষ্টির আগে সৌরজগৎ একটা জ্বলন্ত গ্যাসীয় পিন্ডের
ন্যায় মহাশূন্যে অবস্থান করতো।
৩. এই গ্যাসীয় পিন্ডের
বাইরে অনবরত বিস্ফোরণ ঘটত।
৪. তাঁদের মতে সুদূর অতীতে এক বিশাল নক্ষত্র সূর্যের কাছাকাছি চলে আসে।
ফলে-
৫. আগন্তক নক্ষত্রের টানে সূর্যের উপর অংশ থেকে গ্যাসীয় পদার্থ ছিটকে বেরিয়ে
আসে। এবং-
৬. প্রবল গতিতে আগন্তক নক্ষত্রটি বহুদূর চলে যায়।
✩ গ্রহের সৃষ্টি:
১. বড় নক্ষত্রের টানে সূর্য থেকে কিছু অংশ বিচ্ছিন্ন হয়। (যা সৌরমণ্ডলের
মাত্র ১/৭০০ ভাগ)
২. উক্ত অংশ অজস্র খন্ডে বিভক্ত হয়।
৩.একসময় বড়ো খন্ডগুলির সাথে ছোট খন্ড গুলি যুক্ত হয়। ফলে-
৪. টুকরো টুকরো অংশগুলি ক্রমশ এক কেন্দ্রীভূত হতে হতে গ্রহের সৃষ্টি করেছে।
এ জন্য কোটি কোটি বছর সময় লেগেছিল।
✩ উপগ্রহ সৃষ্টি:
১. অপেক্ষাকৃত ছোটো ছোটো পদার্থ গুলি গ্রহের আকর্ষনে নিজ নিজ কক্ষে আবর্তন
করতে থাকে।
২. এই খন্ড পদার্থ গুলি জমাটবদ্ধ হয়ে উপগ্রহে পরিণত হয় এবং গ্রহের চারদিকে
ঘুরতে থাকে।
✩ উল্কা সৃষ্টি:
১. মহাকাশে বাকি যে পদার্থ কণা রয়ে গেল যেগুলি ঘনাঙ্ক ও হিমাংক অনুযায়ী
জমাটবদ্ধ হয়নি।
২. এরা সৌরজগতে বিক্ষিপ্ত ও ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে থাকে।
৩. এই বিক্ষিপ্ত টুকরোগুলি মহাকাশের উল্কাপিণ্ড।
৪. গ্রহের প্রবল আকর্ষণে পিণ্ডগুলি মহাকাশে ঝরে পড়ে, যাকে তারাখসা বলে।
✩ সমালোচনা:
১. এই তত্ত্বে উপগ্রহ গুলির জন্মের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা মেলে না।
২. এদের তত্ত্ব থেকে পৃথিবীর বার্ষিক গতির উৎপত্তি সম্পর্কে জানা গেলেও
আহ্ণিক গতির ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
৩. উপগ্রহ গুলির কক্ষপথে বৈষম্য কেন রয়েছে তা এই তত্ত্বে জানা যায় না।
৪. এই তত্ত্বে সূর্য ও নক্ষত্র গুলির মধ্যে কৌণিক ভরবেগের বন্টনের সঠিক
ব্যাখ্যা নেই।
৫. সংঘর্ষের কারণে সৃষ্ট গ্রহ কণা একই দিকে কেন ঘূর্ণায়মান হয় তার ব্যাখ্যা
পাওয়া যায় না।
৬. নীহারিকার আকর্ষণে সূর্য থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া পদার্থ গুলির খণ্ড-খণ্ড
অংশ এত সহজে জমাটবদ্ধ হয়ে গ্রহে পরিণত হওয়ার অবস্থা তৈরি করতে পারে না।
৭. গ্রহগুলির আয়তন অনুসারে বন্টন এই তত্ত্বে উপেক্ষিত।
মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব /Big Bang Theory টি আলোচনা করো।
✴ প্রবক্তা: মার্কিন পদার্থবিদ এডউইন হাবল (1924খ্রী)।
✴ মূল বক্তব্য: একটি অসীম ভরযুক্ত প্রায় শূন্য বস্তু থেকে
বিস্ফোরণের মাধ্যমে মহাবিশ্বের যাবতীয় বস্তুর সৃষ্টি।
✴ তত্ত্বের বর্ণনা:
১. 1370 কোটি বছর আগে মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তুও শক্তি প্রচণ্ড তাপ ও চাপের
সাথে একটি "কসমিক এগ" বা "মহাজাগতিক ডিম্ব"- এর মধ্যে পুঞ্জীভূত
ছিল।
২. এটি ছিল অতি উষ্ণ এবং ঘনত্ব ছিল খুব বেশি।
৩. পরে এটি ক্রমাগত শীতল ও প্রসারিত হতে থাকে।
৪. ফলে একসময় অত্যন্ত স্ফীত এগ এর মধ্যে প্রবল বিস্ফোরণ ঘটে। একে Big
Bang বলে।
৫. Big Bang এর পর এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের কম সময়ের মধ্যে আয়তন বৃদ্ধি
ছিল অতি দ্রুত।
৬. তারপর বৃদ্ধি মন্থর হয়ে যায়।
৭. Big Bang ঘটার পর প্রথম তিন মিনিটের মধ্যে প্রথম পরমাণু গঠন শুরু হয়।
৮. Big Bang থেকে তিন লক্ষ বছরের মধ্যেই উষ্ণতা প্রায় 4500 Kতে নামে ও
পারমাণবিক পদার্থের সৃষ্টি হয়।
✴ সৃষ্টির আদিতে মহাবিশ্ব:
১. এই তত্ত্বানুযায়ী সৃষ্টির আদিতে মহাবিশ্ব ছিল আয়তনে ছোটো।
২. গ্যালাক্সি গুলি খুব কাছাকাছি অবস্থান করতো।
৩. সময় পরে মহাবিশ্ব প্রসারণের সাথে সাথে গ্যালাক্সিগুলি
ও প্রসারিত হয়েছে।
✴ সমালোচনা:
মহাবিশ্ব অনন্তকাল প্রসারিত হবে, নাকি আবার সংকুচিত হবে তা নিয়ে বিজ্ঞান
মহলে মতভেদ আছে-
১. যদি অনন্তকাল প্রসারিত হয় তবে তা হবে অসীম বিশ্ব।
২. যদি সংকোচন শুরু হয়, তবে তা হবে সসীম বিশ্ব।
গ্যালাক্সি বা নক্ষত্রলোক কাকে বলে?
✴ সংজ্ঞা: মহাকাশে অবিরাম ঘূর্ণায়মান অসংখ্য নক্ষত্র, নীহারিকা,
গ্রহাণু,গ্যাসপুঞ্জ ও ধূলিকণার বিপুল সমাবেশকে গ্যালাক্সি বলে।
✴ বৈশিষ্ট্য:
১. নক্ষত্র গুলি এর মধ্যে প্রদক্ষিণ করে।
২.এক একটি গ্যালাক্সিতে 100-20 হাজার কোটি নক্ষত্র আছে।
৩. এদের আকার ও আয়তন ভিন্ন।
৪. ক্ষুদ্রতম গ্যালাক্সিতে নক্ষত্রের সংখ্যা প্রায় 1 লক্ষ।
৫. অতিবৃহৎ গ্যালাক্সির নক্ষত্রের সংখ্যা প্রায় 3 হাজার বিলিয়ন(1 বিলিয়ন=100
কোটি)
✴ উদাহরণ:
১. আকাশগঙ্গা গ্যালাক্সি। সূর্য ইহার অন্তর্গত। এতে প্রায় 200-400 বিলিয়ন
নক্ষত্র আছে।
২. আন্দ্রোমেদা, আকাশগঙ্গার নিকটতম গ্যালাক্সি।
সূর্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণাটি ব্যাখ্যা করো?
১. সূর্য একটি বৃহৎ জ্বলন্ত গ্যাসীয় নক্ষত্র।
২. আকাশগঙ্গা গ্যালাক্সির অন্তর্গত।
৩. সূর্য সৌরমণ্ডলের কেন্দ্রে অবস্থিত।
৪. সূর্যের আনুমানিক বয়স 5বিলিয়ন বছর। (500কোটি বছর)।
৫. এটি আরও 5বিলিয়ন বছর আলো ও উত্তাপ দিয়ে যাবে।
৬. মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাসে গঠিত।
৭. সূর্যের পরিধি 13.92 লক্ষ km।
৮. সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা 1.5 কোটি ডিগ্রী সেলসিয়াস।
৯. সূর্যের বহিঃপৃষ্ঠের তাপমাত্রা 6000ডিগ্রী সেলসিয়াস।
১০. সূর্যের বহিঃপৃষ্ঠ থেকে নির্গত শক্তি ক্ষুদ্র তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ
রূপে পৃথিবীতে 8 মিনিট 20সেকেন্ডে পৌঁছায়।
১১. সূর্য কিন্তু নিজেও স্থির নয়।
১২. সূর্য নিজ অক্ষের উপর 24.5 দিনে আবর্তিত হচ্ছে।
✴ ছায়াপথ (Milky Way) বা আকাশগঙ্গা কি?
অসংখ্য নক্ষত্র পাশাপাশি অবস্থানের ফলে গভীর
রাত্রে মেঘমুক্ত আকাশে উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত যে উজ্জ্বল, স্বচ্ছ, সাদা পথ বা
আলোক বলয় দেখা যায় তাকে ছায়াপথ বলে।
আমরা যে নক্ষত্র
জগৎ বা গ্যালাক্সিতে বাস করি তাকে বলে Milky way।এতে আনুমানিক 20হাজার কোটি নক্ষত্র,
60 হাজার কোটি গ্রহ, 72হাজার কোটি উপগ্রহ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। রাতের আকাশে প্রাচীন
নাবিকরা এক ক্ষীণ, অস্পষ্ট আলোর ফিতের মতো এই নক্ষত্র বলয় প্রত্যক্ষ করতেন। এটি খানিকটা
সাদা, ঘোলাটে দুধের মতো। এই ফিতের মতো নক্ষত্র বলয়কে "দুধের রাস্তা" বা
"Milky way" বলে।
✴ নীহারিকা (Nebula) কি?
মহাকাশে রাত্রে যেসব ভাসমান উত্তপ্ত হালকা
গ্যাসীয় পদার্থের সাদা মেঘের টুকরো বা উজ্জ্বল জ্বলন্ত চরকির মতো পূর্ব থেকে পশ্চিমে
ঘূর্ণায়মান জ্যোতিষ্ক দেখা যায় তাদের নীহারিকা বলে।
অর্থাৎ মহাকাশে
নীহারিকা হল ঘূর্ণিঝড়ের মতো গ্যাসের পিণ্ড। এরা সেইসব ছায়াপথ- যাদের মধ্যেকার কোনো
গ্যাস জমে এখনো তারা হয়ে যেতে পারেনি।
উদাহরণ: ক্যাটসআই, অ্যান্ড্রোমিডা
✴ কোয়েজার কি?
মহাবিশ্বে আনুমানিক 109 গ্যালাক্সির উজ্জ্বলতা
নিয়ে ঝলমল করতে থাকা এক অতি উজ্জ্বল তারার মতো দৃশ্যমান বিস্ময়কর মহাজাগতিক বস্তুপুঞ্জকে
কোয়েজার বলে।
✴ ধুমকেতু (Comets) কি?
যেসব জ্যোতিষ্ক সূর্যের চারপাশে অধিবৃত্তাকার
কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে, এদের দুটি অংশ- অষ্টি, পুচ্ছ। ধুমকেতু 75-76 বছর অন্তর পৃথিবীর
আকাশে আবির্ভূত হয়।
উদাহরণ: হ্যালি, মার্কাস, হেলবব,আইসন।
বামন গ্রহ / অপ্রধান গ্রহ (Dwarf planets) বলতে কী বোঝো?
IAU-র মতে যেসকল জ্যোতিষ্ক-
১. সূর্যের চারদিকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে সর্বদা পরিক্রমণ করে, কিন্তু উপগ্রহ
নয়।
২. জ্যোতিষ্কটি পর্যাপ্ত ভরযুক্ত হয়। এই ভর উদস্থিতিক ভারসাম্য বজায় রাখে
ও আকৃতিতে গোলাকার রাখে।
৩. এরা নিজ কক্ষপথের নিকটস্থ অঞ্চল থেকে অন্য সকল মহাজাগতিক বস্তুকে সরিয়ে
ফেলতে পারে না, তাদের বামন গ্রহ বলে।
উদাহরণ: IAU 2006 খ্রী 3টি ও 2008 খ্রী 2টি, মোট 5টি বামন গ্রহের উল্লেখ
করে।
যেমন- সেরেস, প্লুটো, হাউমেয়া, ম্যাকেমা, এরিস।
অন্তঃস্থ গ্রহ ও বহিঃস্থ গ্রহের মধ্যে পার্থক্য লেখ।
অন্তঃস্থ গ্রহ ও বহিঃস্থ গ্রহের মধ্যে পার্থক্য
#
বিষয়
অন্তঃস্থ গ্রহ
বহিঃস্থ গ্রহের
1
আকার
আয়তনে অনেক ছোটো।
অনেক বড়।
2
দূরত্ব
সূর্য থেকে এদের দূরত্ব কম।
সূর্য থেকে এদের দূরত্ব বেশি।
3
পারস্পরিক দূরত্ব
এদের পারস্পরিক দূরত্ব কম।
এদের পারস্পরিক দূরত্ব অনেক বেশি।
4
কক্ষপথ
এদের কক্ষপথের দৈর্ঘ্য ছোটো।
এদের কক্ষপথের দৈর্ঘ্য সুদীর্ঘ।
5
উষ্ণতা
সূর্যের কাছে থাকায় উষ্ণতা অধিক।
দূরে থাকায় খুব শীতল।
6
উপগ্রহ
এদের উপগ্রহ সংখ্যা দু'একটি বা নেই।
এদের উপগ্রহ অনেক, বৃহস্পতির 63টি।
7
পদার্থ
এরা সকলে কঠিন পাথরে গঠিত।
হাইড্রোজেন, হিলিয়াম,অ্যামোনিয়া, মিথেন গ্যাসে গঠিত।
8
উদাহরণ
বুধ ,শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল (4টি)
বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন ও 5টি বামন গ্রহ (মোট 9টি)।
কুলীন বা প্রধান ও বামন গ্রহের পার্থক্য
কুলীন বা প্রধান ও বামন গ্রহের পার্থক্য লেখ।
#
বিষয়
কুলীন বা প্রধান গ্রহ
বামন গ্রহ
1
আয়তন
এদের আয়তন ও ভর অনেক বেশি।
এদের আয়তন ও ভর যথেষ্ট কম।
2
আকৃতি
এদের আকৃতি প্রায় গোলাকার।
অনেক ক্ষেত্রে চ্যাপ্টা।
3
ভরকেন্দ্র
এদের ভরকেন্দ্র নিজেদের মধ্যেই থাকে।
নিজেদের মধ্যে না ও থাকতে পারে।
4
বস্তুকণা
এরা কক্ষপথের আশেপাশের সমস্ত মহাজাগতিক বস্তুকণা সরিয়ে দিতে পারে।
কোনো মহাজাগতিক বস্তু কণা সরাতে পারে না।
5
বিচ্যুতি
এরা কখনো নিজ কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয় না।
এরা অন্যের কক্ষপথে ঢুকে পড়তে পারে।
6
উদাহরণ
বুধ, শুক্র
সেরেস, প্লটো।